তুর্কি জাতি এই বছর আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠার একশ বছর উদযাপনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। একই সাথে, রাজনৈতিক আত্ম-পরিচয়ের জন্য লড়াই করতে হচ্ছে তাদের। তুরস্ক, এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে একটি প্রাকৃতিক প্রবেশদ্বার। দেশটি জাতীয়তাবাদ ও ইউরোপীয় একীকরণের এক রূপক মোড়ে রয়েছে। আর, তার সামনে আছে বিশ্ব মুসলিম রাজনীতির প্রতীকী নেতৃত্বের আহ্বান। আর সব কিছুর কেন্দ্রে রয়েছে, বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিজেপ তাইয়েপ এরদোয়ন পুনরায় নির্বাচিত হওয়ার চেষ্টা।
অনেকে বিশ্বাস করেন যে, তার শাসন বিভাজনকারী। তার শাসন তুর্কি সমাজকে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী এবং রক্ষণশীলদের রাজনৈতিকভাবে ভাগ করে দিয়েছে। এরদোয়ানের সমর্থকরা বেশিরভাগই ধার্মিক, সামাজিকভাবে রক্ষণশীল, তার ক্ষমতাকালে সৃষ্ট একটি নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণি; যারা গ্রামীণ বা শহুরে এলাকায় নতুনভাবে স্থানান্তরিত হয়েছে।
তারা তার আকর্ষনীয় ব্যক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তার ধারাবাহিকতাকে এই শেণি স্থিতিশীলতা হিসাবে দেখে। এরা তার সাধারণ প্রারম্ভকেও প্রশংসা করে; তিনি ফুটবল খেলার প্রতি তার আগ্রহকে বিসর্জন দিয়ে, বাবার আর্থিক সংগ্রামে সাহায্য করতে, রুটি এবং লেমনেড বিক্রি শুর করেছিলেন।
দেয়ালের অন্য দিকে, তার প্রতিদ্বন্দ্বীরা একটি বৃহত্তর জোটে একত্রিত হয়েছেন; যারা বিশ্বাস করেন যে তার 'স্বৈরাচারী' শাসন তুর্কি সমাজের ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধকে কলঙ্কিত করছে। তাদের মতে, এরদোয়ানের 'ইসলাম-রঞ্জিত রাজনীতি' উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতনের পর কামাল আতাতুর্ক কর্তৃক স্থাপিত আধুনিক তুরস্কের ভিত্তির বিরোধিতা করে। দুই দশক আগে ক্ষমতায় আসার পর, ১৪ মে-তে নির্ধারিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এরদোয়ানের জন্য সবচেয়ে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়ে উঠতে পারে।
এই সময়ের মধ্যে, তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনটি মেয়াদ কাটিয়েছেন এবং ২০১৪ সাল থেকে সরাসরি নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১৭ সালে, গণভোটের মাধ্যমে তুরস্ক সংসদীয় ব্যবস্থা থেকে প্রেসিডেন্ট শাসিত পদ্ধতিতে চলে যায়। আর, পরের বছরই এরদোয়ান প্রথম নির্বাহী প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন। এখন ক্ষমতায় তার অবস্থান বদলেছে। আর, তিনি যা প্রতীকায়িত করেন তারও বদল ঘটেছে।
প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তিনি, দুর্বল গণতান্ত্রিক শক্তি, শক্তিশালী সামরিক বাহিনী, প্রতিকূল অর্থনীতি এবং অভ্যুত্থান প্রবন সমাজ সম্বলিত একটি দেশের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। মধ্যপন্থী নীতির মাধ্যমে তিনি সমালোচকদের চমকে দেন, আইএমএফকে মোকাবেলা করেন এবং দেশের অর্থনীতিকে ঘুরিয়ে দেন, ইইউ-এর সদস্যপদ লাভের চেষ্টা করেন, ধর্মীয় বিতর্ক এড়িয়ে যান এবং পশ্চিমা বিশ্বের সাথে দৃঢ় সম্পর্ক চেয়ে নিজেকে গণতন্ত্রপন্থী নেতা হিসেবে চিত্রিত করেন।
এরদোয়ান তার রাজনৈতিক শক্তিকে দৃঢ় করার সাথে সাথে, তিনি ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী এবং একসময়ের ক্ষমতাধর জেনারেলদের পেছনে ঠেলে দিতে শুরু করেন এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করতে থাকেন। তারপর, এক দশক আগে, তাকসিম গেজি পার্কে পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে বিক্ষোভ শুরু হয়। এই বিক্ষোভ সরকারের সঙ্গে সংঘর্ষে পরিণত হয়। আর, রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো কঠোর শক্তি প্রয়োগ করে; তখন সড়ক প্রতিধ্বনিত হয় 'স্বৈরশাসক' স্লোগানে । তুরস্ক জুড়ে ছড়িয়ে পড়া এই বিক্ষোভে বহু বিক্ষোভকারী নিহত হয় বলে জানা যায়।
এর পর, ২০১৬ সালের ব্যর্থ অভ্যুত্থান এরদোয়ানের একটি ভিন্ন দিক প্রকাশ করে দেয়। তিনি সামরিক বাহিনী, বিচার বিভাগ, সুশীল সমাজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মিডিয়াসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠানকে শুদ্ধ করতে ব্যাপক অভিযান শুরু করেন; হাজার হাজার মানুষকে কারারুদ্ধ করেন তিনি। সর্বশক্তিমান প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য আরো ক্ষমতা বাড়িয়ে এরদোয়ান সংবিধান সংশোধন করেন।
পর্যবেক্ষকরা বিশ্বাস করেন যে আরব বসন্তের ব্যর্থতা এরদোগানকে প্যান-ইসলামিস্টে পরিণত হওয়ার আত্মবিশ্বাস দেয়। তুর্কি বিষয়ক বিখ্যাত বিশেষজ্ঞ এবং ব্রুকিংস ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো অধ্যাপক কামাল কিরিসি বলেন, "আরব বসন্তের সময় এরদোগান নিজেকে প্যান-ইসলামিস্ট মনে করতেন... তিনি এমন এক সময়ে মুরসির নেতৃত্বাধীন মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতি সমর্থন যুগিয়েছিলেন, যখন সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইন এই গোষ্ঠীর উপর চাপ সৃষ্টি করছিলো।”
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন আরব বসন্ত পরবর্তী প্রভাব এবং পরবর্তী পর্যায়ে, তুরস্কে গেজি পার্কের বিক্ষোভের পর, জনগণ এরদোয়ানকে তার মুখোশ খুলে ফেলতে দেখেছে। তিনি সকল ভিন্নমতাবলম্বীকে কঠোর হাতে দমন করেন; বলেন, নারীদের পুরুষের সমকক্ষ হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। নারীবাদীদের বিরুদ্ধে তিনি মাতৃত্বকে প্রত্যাখ্যান করার অভিযোগ করেন এবং ইসলামী ঐতিহ্যের মধ্যে তুর্কি সমাজের শেকড় খোঁজার দিকে মনোনিবেশ করেন।
তার সমালোচকরা ধর্মীয় বিদ্যালয়, মসজিদের তীব্র উত্থান এবং রাষ্ট্র-চালিত ধর্ম বিষয়ক সংস্থা বা ধর্ম বিষয়ক অধিদপ্তরের ক্রমবর্ধমান প্রভাবগুলো তুলে ধরেন।
এরদোয়ানের ইসলামিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়, কিশোর বয়স থেকেই তার ধর্মের প্রতি ঝোঁকের মধ্যে। তিনি একটি ধর্মীয় বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন এবং ইসলামপন্থী ওয়েলফেয়ার পার্টির যুব শাখায় রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ লাভ করেন। এমনকি তিনি প্রকাশ্যে একটি কবিতা আবৃত্তি করে 'ধর্মীয়' অনুভূতির উসকানি দেয়ার জন্য জেলও খাটেন। কবিতাটি এমন; "মসজিদগুলো আমাদের ব্যারাক, গম্বুজগুলো আমাদের হেলমেট, মিনার গুলো আমাদের বেয়নেট এবং বিশ্বাসীরা আমাদের সৈন্য।"
এরদোয়ান ঐতিহাসিক হায়া সোফিয়াকে এক সক্রিয় মসজিদ হিসেবে আবার চালু করেন, যা একসময়ের বাইজেন্টাইন যুগের ক্যাথেড্রাল ও যাদুঘর ছিলো। রাষ্ট্র-চালিত ধর্মীয় সংস্থার প্রধান আলি এরবাস তলোয়ার হাতে খুতবা প্রদান করেন। এই ধরনের পদক্ষেপ তার ইসলামপন্থী মূল সমর্থকদের উৎসাহিত করে। আর, দেশকে তিনি যে-দিকে নিয়ে যেতে চান, তা অন্যদেরকে উদ্বিগ্ন করে তোলে। কারণ তার পদক্ষেপগুলো আধুনিক তুরস্কের ভিত্তি-আদর্শের বিরোধিতা করে।
"কামাল আতাতুর্ক তুরস্ককে ধর্মনিরপেক্ষ, ইউরোপীয়, পশ্চিমমুখী দেখতে চেয়েছিলেন। আর, এরদোয়ান, যেমন আমি তাকে আতাতুর্ক বিরোধী বলি, কারণ তিনি আতাতুর্কের মূল্যবোধকে ধারণ করেন না, তিনি তুরস্ককে ইসলামী, মধ্যপ্রাচ্যের মতো এবং সামাজিকভাবে রক্ষণশীল হিসেবে দেখতে চান"। ভয়েস অফ আমেরিকাকে এ কথা বলেছেন ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউটের তুর্কি গবেষণা প্রোগ্রামের পরিচালক ও লেখক সোনার ক্যাগাপ্টে। তিনি আরো বলেন, "এরদোয়ান অনেক কিছু করেছেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এনেছেন, কিন্তু সাধারণ ভোটারের চোখে তিনি আতাতুর্কের কাছাকাছিও নন।"
এরদোয়ানের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হলেন কামাল কিলিকদারোগলু। তিনি একশ বছর আগে আতাতুর্ক প্রতিষ্ঠিত সিএইচপি পার্টির প্রধান। গত কয়েক বছরে, রাজধানী আঙ্কারা এবং ইস্তাম্বুল উভয় মহানগর এরদোযানের হাতছাড়া হয়ে যায়। এই নগর দুটিতে তার মেয়র প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছে হেরে যান। তারা এখন গুরুত্বপূর্ণ কুর্দিপন্থী দল এইচডিপি-র সমর্থনও পাচ্ছে।
তুরস্কে রাজনৈতিক অস্থিরতা স্পষ্ট। অভ্যন্তরীণভাবে, 'ভঙ্গুর' অর্থনীতির জন্য এবং সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের কারণে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছে। ঐ ভূমিকম্পে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ নিহত এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থরা এরদোয়ানের নেতৃত্বাধীন সরকারকে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকায় ত্রাণ পাঠাতে 'অক্ষম' বলে অভিযুক্ত করেছেন। আন্তর্জাতিকভাবে, এই দেশের যে কোনো অস্থিতিশীলতা পশ্চিমকে উদ্বিগ্ন করে। এর কারণ দেশটির ভূ-কৌশলগত অবস্থান। ইউরোপের প্রবেশদ্বার এই দেশের পূর্বে আঞ্চলিক শক্তি ইরান, আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজান, দক্ষিণে সিরিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্বে ইরাকের সীমান্ত। বর্তমানে এটি লক্ষাধিক সিরীয় শরণার্থীর আশ্রয়দাতা।
এরদোয়ানের প্রতিদ্বন্দ্বীরা দাবি করছেন, আসন্ন নির্বাচন ‘স্বৈরাচারী’ শাসন যুগের অবসান ঘটাবে। তবে, এরদোয়ান হেরে গেলে যে বিশৃঙ্খলা শুরু হতে পারে, তা নিয়ে তুরস্কের মানুষের উদ্বেগ রয়েছে।
অধ্যাপক কেমাল কিরিসি বলেন,"আমি এমন একটি দৃশ্যের কথা ভাবতেও চাই না, যেখানে এরদোয়ান এবং তার অনুসারীরা নির্বাচনের ফলাফল মানছেন না। এমন হলে, সত্যিই দেশটি চীন ও রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন স্বৈরাচারী বিশ্বের সারিতে তুরস্কের যোগদানের একটি সীলমোহর হয়ে উঠবে।"